যীশু কুমার আচার্য্য (চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি)
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সনে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতাও অর্জন রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা সহ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বাধীন, রাষ্ট্রের কিছু কিছু বিভাগে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডঃ বদিউল আলম মজুমদার। পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন জনাব সরফরাজ হোসেন। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান। দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডঃ ইফতেখারুজ্জামান। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডঃ শাহদীন মালিক।
আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে, অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারের ১৯৯০ সনে পদত্যাগের পর ১৯৯১ সনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি জনাব সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ এর নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন হয়। ঐ সংসদের ৫ বছর মেয়াদ পূর্তির ২ বছর আগেই সংসদের বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদ হতে পদত্যাগ করে “তত্ত্বাবধায়ক সরকার” এর অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলে। সেই আন্দোলনে বাংলাদেশ জামায়েত ইসলামী সহ বেশ কিছু দল সমর্থন করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীকে অগ্রাহ্য করে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই ১৯৯৬ সনের ১৫ ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করলেও সেই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সহ অনেক দল অংশগ্রহণ করে নাই। ফলে ১৯৯৬ সালে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া সরকার ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত করে এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পদত্যাগের মাধ্যমে ঐ সংসদের অবসান ঘটে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সনে প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর জাতীয় পাটি সহ আরো কিছু দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ঐক্যমতের সরকার ২০০১ সালে মেয়াদ পূর্ণ হলে পুনরায় ঐ বছরেই বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়ে অনেক কিছু ঘটে। একপর্যায়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ডঃ ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ২৯ শে অক্টোবর ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় দেশে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হয়, সেই সাথে উনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়ায় অনেক উপদেষ্টা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে। ফলে প্রফেসর ডঃ ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরী অবস্থা জারী করে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সালে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ডঃ ফখরুদ্দিন আহম্মেদ এর নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন, দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে থাকে। ডঃ ফখরুদ্দিন আহম্মেদ এর নেতৃত্বে ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে আওয়ামীলীগ দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে ডঃ ফখরুদ্দিন আহমেদ এর নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তি ঘটে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালে ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়। এছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়।
২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর হতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, দলীয় সরকার তথা “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ” নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও এই সব নির্বাচন নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক ও সমালোচনা হয়েছে। গত ৭ই জানুয়ারি ২০২৪-এ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সহ সমমনা দলগুলো অংশগ্রহণ করে নাই। অতঃপর সরকারি চাকরিতে কোটার পরিমাণ কমিয়ে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার দাবিতে বাংলাদেশ কোটা সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত হয়। ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট তিনবার কোটা সংস্কারের জন্য বড় ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হয়। সর্বপ্রথম বড় ধরনের কোটা সংস্কার আন্দোলন হয় ২০১৩ সালে। এরপর ২০১৮ সালে আন্দোলনের পর আন্দোলনকারীদের পক্ষে পরিপত্র ঘোষণা করা হয়। কিন্তু হাইকোর্ট কর্তৃক এই পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করায় ২০২৪ সালে পুনরায় আন্দোলন শুরু হয়। প্রত্যেক বার আন্দোলনের সময় বাংলাদেশ পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের উপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়।
অতঃপর মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের আদেশ ও ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র বাতিল করে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ২০-তম গ্রেড পর্যন্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশের কোটা নির্ধারণ করে দেয়। এই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার জামায়েত ইসলামী বাংলাদেশ এর নিবন্ধন বাতিল করলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এক দফায় রূপান্তর হয়। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এর দাবীতে তীব্র গন-আন্দোলন হয়। তৎ প্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ হতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা’র পদত্যাগের প্রেক্ষিতে সরকারের শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকার গত ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে এই শূন্যতার অবসান ঘটে। নতুন এই সরকারে উপদেষ্টা মোট ২১ জন, যাদের মধ্যে দুইজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রয়েছে।
দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আশানুরূপ গ্রহণযোগ্য হয়নি। এছাড়াও নির্বাচন কমিশন ও কার্যত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেনা। একটি জাতীয় নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারী সহযোগীতা প্রয়োজন হয়। একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন ও সরকার-কে অনেক নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হয়। তবেই নির্বাচন সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়। তৎ প্রেক্ষিতে অন্তবর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অর্ন্তভুক্তক্রমে প্রতি ৫ বছর পর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই সরকারের অধীনে হোক। এর স্বপক্ষে রাজনৈতিক দল সমূহের মতৈক্য প্রয়োজন। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার এই বিষয়ে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটির মাধ্যমে একটি সুপারিশ তৈরী করতে পারে, যাহা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার কর্তৃক সংসদে বিলটি পাস করে সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে পাশাপাশি তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। আমরা চাই সংবিধানের সাধে সাংঘর্ষিক না হয়, সেইভাবে অন্তবর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত হোক। তবেই সরকার পদত্যাগ আন্দোলনের জন্য শত শত লোক-কে অকালে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবেনা। দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবেনা। সরকার পদত্যাগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অবসান হোক। শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের পদত্যাগ হোক। দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকুক। অর্থনৈতিক গতিধারা স্বাভাবিক থাকুক। দেশে সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করুক। নিরাপদ হোক মানুষের জীবনধারণ।
লেখক: যীশু কুমার আচার্য্য, আইনজ্ঞ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী। জেলা প্রতিনিধি জাতীয় দৈনিক মুক্তিযুদ্ধ ৭১ সংবাদ ও নিউজবাংলা এনবি। সদস্য- অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকঃ ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ক্লাব এন্ড হিউম্যান রাইটস।